বুধবার, ১১ নভেম্বর ২০২০
প্রথম পাতা » বিশ্ববিদ্যালয় | ভর্তি পরীক্ষা | শিক্ষাঙ্গন » ঢাবির ভর্তি পরীক্ষার ইউনিট বাতিলের প্রস্তাবে পক্ষে-বিপক্ষে শিক্ষক-প্রশাসন
ঢাবির ভর্তি পরীক্ষার ইউনিট বাতিলের প্রস্তাবে পক্ষে-বিপক্ষে শিক্ষক-প্রশাসন
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ডিনস কমিটির সভায় পাঁচ ইউনিটের পরিবর্তে তিন ইউনিটের আওয়তায় ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার প্রস্তাব করা হয়। সেক্ষেত্রে ‘ঘ’ এবং ‘চ’ ইউনিটকে বাতিল করে ‘খ’ ইউনিটের সাথে সমন্বিত করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। সেটি আগামী শিক্ষাবর্ষে (২০২১-২২) থেকে কার্যকর করা হতে পারে।
বর্তমানে পাঁচটি ইউনিটে ভাগ করে ঢাবিতে স্নাতক প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষা নেয়া হয়। এগুলো হলো- বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত ‘ক’ ইউনিট, কলা অনুষদভুক্ত ‘খ’, বাণিজ্য অনুষতভুক্ত ‘গ’, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত ‘ঘ’ ইউনিট এবং চারুকলা অনুষদভুক্ত ‘চ’ ইউনিট। তবে ডিনস কমিটির প্রস্তাব হলো- ‘ঘ’ ও ‘চ’ ইউনিটকে বাতিল করে বাকি তিনটি ইউনিটে পরীক্ষা নেয়া।
এদিকে, এই দুই ইউনিট বাতিলের এ প্রস্তাবে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে ঢাবি প্রশাসন ও শিক্ষকরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মন্তব্য পাওয়া যায়। ইউনিট বাতিলের পক্ষে উপাচার্যসহ শিক্ষকদের একাংশ। তবে ইউনিট বাতিলের বিপক্ষেও রয়েছে প্রশাসনিক বড় একটা অংশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ক’, ‘খ’, ‘গ’ ইউনিট ছাড়াও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত ‘ঘ’ ইউনিটের মাধ্যমে একটা বড় অংশের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। যাদের অধিকাংশই নিজের শিক্ষাধারার বাইরে গিয়ে ভিন্ন একটি ধারা তথা বিষয়ে পড়ালেখার সুযোগ পায়। এটি বন্ধ হলে শিক্ষার্থীদের মেধা যাচাইয়ের প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে বলে মনে করছেন শিক্ষাক-শিক্ষার্থী ও বিশেষজ্ঞরা।
ইউনিট বাতিলের পক্ষে মত দিয়েছেন খোদ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান। তিনি বলেন, উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা যে তিনটা ধারায় পড়াশোনা করে, অর্থাৎ- বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ; সেই তিন ধারাকে বিবেচনায় রেখে তিনটি ইউনিটে ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হবে। পাঁচ ইউনিটের পরিবর্তে তিনটি ইউনিটের আওতায় পরীক্ষাগুলো নেওয়া হবে। ইউনিটের যে কোনো নামকরণ হতেই পারে। এতে যেটা হবে, পরীক্ষা নেওয়ার চাপ কমে আসবে।
পরীক্ষার পরিবর্তন আনার বিষয়ে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তক মুখী করা এবং গ্রাম-শহরের পার্থক্য দূর করতেই আমাদের এই নীতিগত সিদ্ধান্ত। তবে যারা বিভাগ পরিবর্তন করতে ইচ্ছুক তাদের জন্য সে ধরনে সুযোগ থাকবে।
উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, উচ্চমাধ্যমিকের বিভাগ অনুযায়ী পরীক্ষার বিষয়টি নিয়ে ২০১৮ সাল থেকে আলোচনা চলছিল। এখন প্রস্তাব আকারে এসেছে। এটা নিয়ে আরও আলোচনা-পর্যালোচনা হবে।
ঢাবির ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. হাসানুজ্জামান ‘খ’ ইউনিটের আদলে নেয়া ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা উঠিয়ে দেয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। সেক্ষেত্রে একই ন্যাচারের দু’টি পরীক্ষা না নেয়ার পক্ষে যুক্তি দেন তিনি।
অন্যদিকে, হুট করেই ইউনিট বাতিলের পক্ষে সায় নেই উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদের। তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ বিভাগ বা বিষয় পরিবর্তনের মাধ্যমে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত ‘ঘ’ ইউনিটের মাধ্যমে ভর্তি হয়। আবার ‘চ’ ইউনিটের শিক্ষার্থীদের একটি বিশেষ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নির্বাচন করা হয়। যা ইউনিট দুটোর স্বাতন্ত্র্যের বহিঃপ্রকাশ। তাই বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘ঘ’ ও ‘চ’ ইউনিট বন্ধের মতো সিদ্ধান্ত ভেবে-চিন্তেই নিতে হবে।
‘ঘ’ ও ‘চ’ ইউনিট বাতিলের বিপক্ষে অনড় অবস্থান ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার সমন্বয়ক এবং ডিনদ্বয়। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন এবং ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার সমন্বয়ক অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম সোমবার (৯ নভেম্বর) সন্ধ্যায় ভার্চ্যুয়াল প্ল্যাটফর্মে সভার আয়োজন করেন। সভায় অনুষদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে সম্মিলিত মত দিয়েছেন বিভাগের ৬০ জন শিক্ষক। এর ওপর ভিত্তি করেই বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় মতামত উপস্থাপন করবেন তারা।
এ বিষয়ে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেই বিকল্প খুঁজে বের করার পক্ষে এবং পরীক্ষা-প্রক্রিয়ার আধুনিকীকরণ নিয়ে ভাবার কথা বলেছেন।
অন্যদিক, ‘চ’ ইউনিট বাতিলের বিষয়ে ডিনস কমিটিতে কোনো আলোচনাই হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. নিসার হোসেন। হঠাৎ করে এমন আলোচনা ওঠার বিষয়ে কোনো যুক্তি দেখছেন না উল্লেখ করে তিনি বলেন, চারুকলায় পরীক্ষা হবেই।
এ সময়ে প্রয়োজনে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে চারুকলা অনুষদগুলোতে গুচ্ছ পদ্ধতিতে যাওয়ার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে তিনি বলেন, পরীক্ষা ছাড়া চারুকলার বিকল্প নেই। দরকার হলে আমরা সব বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটগুলো একযোগে আলাদা গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার কথা ভাবতে পারি। তখন কি করবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়?
এদিকে, ইউনিট বাতিলের প্রস্তাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও পক্ষে-বিপক্ষে মন্তব্য পাওয়া যায়। দুই ইউনিট বাতিলের প্রস্তাবকে নেতিবাচক মনে করার পিছনে অনুষদের অর্থ আয়ের বিষয়টিকে এক করে দেখে ফেরদৌস আলম নামে এক সাবেক শিক্ষার্থী বলেন, একটা ইউনিট ভর্তি পরীক্ষা হয় সেই অনুষদের ডীনের অধীনে। যা আয়-রোজগার হয় সব সেই ডিনের হাতে থাকে। কে চায় তাঁর লস করতে।
অন্যদিকে, ইউনিট বাতিলের এই সিদ্ধান্ত নেতিবাচক মনে করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী শরীফুল হাসান। তিনি বলেন, নিজের জীবনের অভিজ্ঞতায় জানি আমাদের দেশের বহু ছেলেমেয়ে বিজ্ঞান, কলা কিংবা ব্যবসা শাখা নেয় বাবা-মা বা স্কুলের শিক্ষকদের কারণে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসে অনেকেই এখান থেকে বেরিয়ে আসার স্বাধীনতা পায়। বুয়েটে পড়তে চায় এমন অনেক ছেলেমেয়েকে আমি কখনো মেডিকেলে পরীক্ষা দিতে দেখিনি। যার যেখানে পড়তে ভালো লাগে সেখানেই যাওয়া উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের এ সিদ্ধান্তকে ভুল আখ্যা দিয়ে এ থেকে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
ডিনস কমিটির এ সিদ্ধান্তকে এখতিয়ার বহির্ভূত বলে মনে করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খান। তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া কিংবা প্রস্তাব দেওয়ার কোনো আইনগত এখতিয়ার ডিনস কমিটির নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা বা ব্যবস্থাপনা কাঠামোতে ডিনস কমিটি নামে কোনো কিছুর আইনগত অস্তিত্বও নেই।
তিনি আরও বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ ১৯৭৩-এর ২৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, পরীক্ষাসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার শুধু একাডেমিক কাউন্সিলের। ডিনস কমিটির সিদ্ধান্ত বা প্রস্তাবকে বৈধতা দেওয়া একাডেমিক কাউন্সিলের কাজ নয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান ফেসবুকের এক পোস্টে লিখেছেন, ‘ঘ’ ইউনিটের মাধ্যমে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে পড়ার সুযোগ পান। এই ইউনিট বিলুপ্তির পর কীভাবে এই ল্যাটেরেল শিফট (বিভাগ বদল) ঘটবে, জানি না। তবে কোনো অবস্থাতেই বিজ্ঞান থেকে সামাজিক বিজ্ঞান ও কলার বিষয়গুলোতে পড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা ঠিক নয়।