বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯
প্রথম পাতা » Default Category | সাক্ষাৎকার » আমদানী নয়, রপ্তানীই হবে আমাদের তরুন প্রজন্মের মূল লক্ষ্য - মোঃ আবদুল মোমেন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, চায়না বাংলাদেশ এক্সপোর্ট লিমিটেড
আমদানী নয়, রপ্তানীই হবে আমাদের তরুন প্রজন্মের মূল লক্ষ্য - মোঃ আবদুল মোমেন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, চায়না বাংলাদেশ এক্সপোর্ট লিমিটেড
চায়নার বাজার থেকে পণ্য কিনে খুব সহজেই আপনি আমদানি ব্যবসায় যুক্ত হতে পারেন। সুলভ মূল্যের কারণে সারা বিশ্বে চীনা পণ্যের চাহিদা অনেক বেশি। জুয়েলারি থেকে শুরু করে নানা রকম বিচিত্র পণ্যের সম্ভার আছে দেশটিতে। প্রথমেই সিদ্ধান্ত নিন পাইকারি হারে আপনি কোন পণ্যটি কিনতে চান। যে পণ্যটি কিনতে চাইছেন, সেটা মান কেমন সেব্যাপারে নিশ্চিত হন। অনলাইন ঘাঁটুন, দেখুন রিভিউ আছে কিনা। এমন একটি পণ্য নির্বাচন করুন যা বেচা-কেনা করতে আপনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন। মানুষের কাছে পণ্যটির চাহিদার ব্যাপারটিও বিবেচনায় রাখুন, সেক্ষেত্রে ট্রেন্ডি আইটেম যেমন, স্মার্ট ফোন থেকে শুরু করে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসও আপনার পণ্যের তালিকায় থাকতে পারে। নিজে নিজে কিছু প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে খোঁজ-খবর করুন। যেহেতু আপনি দূরে থেকে পন্য ক্রয়ের ব্যপারটি পরিচালনা করবেন সেহেতু আগে থেকেই নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানটির অর্থনীতি এবং পরিবহন ব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন। প্রাথমিকভাবে এলসি ছাড়া আপনার ব্যবসায় সাহায্য করতে পারবে এমন আমদানিকারকের সাথে ব্যবসায়ীক সম্পর্ক গড়ে তুলুন। শিক্ষাবিচিত্রার পাঠকদের সাথে এমন একজন আমদানি ও রপ্তানিকারকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেব যিনি ৬মাস চায়না এবং ৬ মাস বাংলাদেশে থাকেন। তিনি চায়নাতে পণ্য সোর্সিং থেকে আরম্ভ করে ডেলিভারি পর্যন্ত সহযোগিতা করে থাকেন। শিক্ষাবিচিত্রার আইটি সম্পাদক জিল্লুর রহমান সোহেল এর সাথে কথা হয় চায়না আমদানী-রপ্তানী লাইসেন্স প্রাপ্ত সফল উদ্যোক্তা ও তরুন প্রজন্মের প্রিয় ব্যক্তিত্ব আবদুল মোমেন এর সাথে।
শিক্ষাবিচিত্রা: আমরা জানি আপনি সরকারী চাকুরি করতেন। কেন এবং কিভাবে চায়না ব্যবসা করার আগ্রহ হলো?
মোঃ আবদুল মোমেন: পরিবারের ইচ্ছা ছিল আমি একজন সরকারী কর্মচারী কিংবা কর্মকর্তা হবো জীবনটা যেন নিরাপদ থাকে। কিন্তু ছোট বেলা থেকেই আমার ইচ্ছা ছিল আমি একজন উদ্যোক্তা হবো।হ্যাঁ আমি বাংলাদেশ আর্মিতে ছিলাম। পরিবারের মন রক্ষার্থে খুবই স্বল্প সময়ই যুক্ত ছিলাম। কিন্তু এ পরিচয় আমি দিতে চাই না। উদ্যোক্তা হিসাবেই পরিচয় দিতে আমি গর্ব বোধ করি। ২০১০ সালে অক্টোবর মাসে চায়নাতে ক্যান্টন ফেয়ারে প্রথম যাওয়ার সুযোগ হয় আমার পরিবারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে। তার পর থেকেই নিয়মিত আমদানী-রপ্তানী ব্যবসায় নিজেকে নিয়োজিত করি। আমি এখন চায়নাতে ইনভেস্টর হিসেবে একটি বৈধ প্রতিষ্ঠানের কর্নধর। চায়না সরকার আমাকে আমদানী-রপ্তানী লাইসেন্স প্রদান করেছেন।
শিক্ষাবিচিত্রা: চায়নাতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ফেয়ার হয় এ সম্পর্কে কিছু জানাবেন।
মোঃ আবদুল মোমেন: চায়নাতে কিছুদিন পরপর ইন্টারন্যাশনাল ও ঘরোয়া বিভিন্ন ফেয়ার বা মেলা হয়। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফেয়ার হচ্ছে ‘ক্যান্টন ফেয়ার’। বছরের দুবার অনুষ্ঠিত হয় অক্টোবরে উইন্টার ও এপ্রিলে সামার এই দুবার ফেয়ার হয়। এই মেলায় পৃথিবীর সব রাষ্ট্রের লোকজন আসে। এখানে পঞ্চাশ হাজারেরও বেশী স্টল এবং এক লক্ষেরও বেশী পণ্য প্রদর্শন করা হয়। এসব ফেয়ারে যে কেউ অভিজ্ঞতা গ্রহন করলে যার যার স্বপ্নের ও ইচ্ছা অনুযায়ী নিজেকে ব্যবসায় নিয়োজিত করবে এটা নিশ্চিত।আমাদের হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন তুমি যদি কারো সাথে ব্যবসা করতে চাও তবে তার সাথে সফরে যাও। চায়নাতে এসব ফেয়ারে সফর করলে ব্যবসায়িক জ্ঞান বৃদ্ধি এবং যার সাথে ব্যবসা করবেন তার সম্পর্কে পূর্নাঙ্গ ধারনা পাওয়া যায়।
শিক্ষাবিচিত্রা: আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) জ্ঞানার্জনের জন্য সুদূর চায়নাতে যাবার কথা বলেছেন। আপনার দৃষ্টিতে মন্তব্য জানাবেন?
মোঃ আবদুল মোমেন: আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন, তোমরা জ্ঞান অর্জনের জন্য চায়না যাও। কেনো বলেছেন সুন্দর ব্যখ্যা আছে। ওনার আপন মামা সাদ বিন সাবি ওয়াক্কাস (রাঃ) অত্যান্ত বীর যোদ্ধা ছিলেন। তিনি অনেক যুদ্ধে জয় লাভ করেছিলেন। দুনিয়াতে থাকতেই যে দশ জন সাহাবী জান্নাতের সু-সংবাদ পেয়েছিলেন তার মধ্যে তিনিও একজন। উনি ওসমান (রাঃ) এর সময়ে চায়নাতে ইসলাম প্রচারের জন্য আসেন। তখন গুয়াঞ্জুর প্রাচীন নাম ছিল ক্যান্টন। সাদ বিন সাবি ওয়াক্কাস (রাঃ) এর ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে তখনকার ক্যান্টনের রাজাতাকে একটি মসজিদ নির্মান করে দেন। এই মসজিদকে কেন্দ্র করে আরবরা আসা যাওয়া আরম্ভ করে। তখন থেকেই ক্যান্টন হয়ে গেল ব্যবসা কেন্দ্র। আমার অফিসের কাছেই সাদ বিন সাবি ওয়াক্কাস (রাঃ) এর কবর। এখনও লক্ষ লক্ষ বিভিন্ন দেশেরমুসলিমএ মসজিদে নামাজ পড়তে আসেন। তাই যদি সত্যিকারের একজন উদ্যোক্তা হতে চাইলে চায়না সফর করে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করুন এবং তা বাস্তবে রুপান্তরিত করুন। নিজেকে এবং দেশকে আরও সামনের দিকে নিয়ে যান।
শিক্ষাবিচিত্রা: চায়না কিভাবে শিল্প বিপ্লবে প্রসার ঘটলো বলে মনে করেন?
মোঃ আবদুল মোমেন: আমি বেইজিং এ একটি একটি কনফারেন্সে গিয়েছিলাম সেখানে চায়নার প্রেসিডেন্ট শিং জিং পিং কে প্রশ্ন করা হয়েছিল Whats the difference between the ‘Shing Jing Ping’ and USA president ‘Trump’ তখন প্রেসিডেন্ট শিং জিং পিং বলেছিলেনচায়নারপণ্য পৃথিবীর ২০০টি দেশে আছে। এ ২০০টি দেশে ৬০০ কোটি মানুষ আছে, এ ছয় শত কোটি মানুষের সবার হাতে কিভাবে চায়নার এসব পণ্য পৌঁছানো যায় এসব নিয়ে আমি চিন্তা করি। আমার যুদ্ধ করার ইচ্ছা নাই তবে আমাকে আক্রমন করলে আমি তার বিপরীতে উপযুক্ত আক্রমন করবো। এ উত্তর থেকেই বোঝা যায় কেন শিল্প বিপ্লবের প্রসার হয়েছে। চায়না সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হচ্ছে শিল্প। লেখাপড়া থেকে আরম্ভ করে সবকিছুতেই কারিগরি শিক্ষা ও শিল্পকে গুরুত্ব দিয়েছেন।
শিক্ষাবিচিত্রা: একজন তরুন কিভাবে চায়নার সাথে ব্যবসা আরম্ভ করতে পারবে। বিস্তারিত জানাবেন?
মোঃ আবদুল মোমেন: চায়না থেকে বাংলাদেশে ইলিকট্রিক, ইলেকট্রনিক্স পণ্য ও মেশিনারিজ, কেমিকেল, খেলনা ইত্যাদি আমদানী করা হয়। চায়না থেকে পঞ্চাশ হাজারেরও বেশী ধরনের পণ্য বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। যে কোন একটি বাছাই করে পণ্য এনে বাংলাদেশে মার্কেটিং করা যেতে পারে কিংবা চায়না থেকে মেশিনারিজ এনে কিছু পণ্য দেশেই তৈরী করে দেশে বিদেশে বিক্রির ব্যবস্থা করা যেতে পারে।আগে চায়নাতে ভ্রমন করে সিদ্ধান্ত গ্রহন করা উচিৎ। যাদের ৩/৪টা দেশ ভ্রমন করা আছে তাদের ভিসা পাওয়া কিছুটা সহজ হলেও নতুন পাসপোর্টধারীদের জন্য একটু কঠিন। তবে অভিজ্ঞ ব্যবসায়ীদের সহযোগীতায় ভিসা পেতে সহজ হবে। চায়নাতে যদি কেউ যেতে চায় তবে মোটামুটি একলক্ষ টাকার একটা বাজেট খরচ হিসাবে ধরা যেতে পারে।আসার সময় বন্ধু-বান্ধব, পারা-প্রতিবেশীদের কিছু পছন্দের পণ্য নিয়ে এসে চায়না ভ্রমনের খরচ উঠিয়ে ফেলতে পারে যে কেউ, পুরাপুরি না উঠলেও অভিজ্ঞতা হিসাবে এটাকে ইনভেস্ট হিসাবে ধরে নিতে হবে।
শিক্ষাবিচিত্রা: বাংলাদেশ থেকে কি কি পণ্য এবং কিভাবে রপ্তানী করা যায়। বিস্তারিত জানাবেন?
মোঃ আবদুল মোমেন: পৃথীবির সব রাষ্ট্রের সব রাষ্ট্রে এম্বাসী বা হাই-কমিশন থাকে। এ হাই-কমিশনে কমার্শিয়াল ডিপার্টমেন্ট নামক একটি বিভাগের কাজ হচ্ছে নিজ দেশের পণ্যকে ঐ দেশে হাইলাইট করা। আমি কিছুদিন আগে বেইজিং এ অবস্থিত বাংলাদেশী এম্বাসীতে গিয়েছিলামসেখানকার কমার্শিয়াল কাউন্সিলর আমাকে জানালেন, আমাদের রপ্তানী বৃদ্ধি করতে দেশের সরকারের একটি চাপ থাকে সব সময়। বানিজ্য মন্ত্রাণালয়ের মন্ত্রী মহোদয় সব সময় আমাদের চাপে রাখেন রপ্তানী বৃদ্ধি করার। আমরাও সে অনুযায়ী কার্যক্রম করে থাকি।
আমিও ব্যক্তিগত ভাবে বাংলাদেশ থেকে আমদানী করা থেকে রপ্তানী করার প্রতি গুরুত্ব বেশী দিচ্ছি। এতে সরকার থেকেও আমরা সুযোগ সুবিধা পাচ্ছি। ট্যাক্স রিবিট বলে একটা শব্দ আছে। বাংলাদেশ থেকে অন্য দেশে পণ্য এক্সপোর্ট করলে ১৭% সরকার ভর্তূকি দেয়। এটাই হচ্ছে ট্যাক্স রিবিট। হতে পারে এগ্রো ফুড কিংবা হতে পারে গার্মেন্স পণ্য, যে কোন পণ্য রপ্তানী করলেই দেশের ও নিজের উন্নয়ন করা সম্ভব।
আমাদের দেশে আমদানী-রপ্তানী সনদ নিয়ে ৯৯% ব্যবসায়ীই আমদানী কারক হিসাবে ব্যবসা পরিচালনা করছে। যারা বিভিন্ন দেশ থেকে পণ্য এন আমাদের দেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে এবং আমাদের নিজস্ব শিল্পকে ধ্বংশ করছে। আমাদের দেশের টাকা বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে।আমরা এত পরিমান আমদানী করি তার বিপরীতে খুবই সামান্য পরিমান রপ্তানী করি। বাংলাদেশী অনেক পণ্য ডিউটি ফ্রিতে চায়নায় রপ্তানী করা যায়। অতএব রপ্তানী বানিজ্যে আমাদের বাংলাদেশের তরুন প্রজন্মের অনেক সুযোগ আছে। দুবাই ওমান সহ অন্যান্য দেশেও বাংলাদেশী এম্বাসীতে একইভাবে রপ্তানী বানিজ্যের গুরুত্ব আরোপ করেন। কিন্তু আমাদের যুব প্রজন্মকে এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে।আমদানী নয়, রপ্তানী হবে আমাদের তরুন প্রজন্মের মূল লক্ষ্য। আমরা চায়না থেকে বিভিন্ন মেশীনারিজ ও টেকনোলজি নিয়ে এসে বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন করে তা বিদেশে রপ্তানী করবো। এটাই হবে আমাদের ব্যবসার মূল উদ্দেশ্য।
শিক্ষাবিচিত্রা: আমাদের তরুন প্রজন্মের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন?
মোঃ আবদুল মোমেন: আমরা পারিবার থেকে শিখে আসি চাকুরি করতে হবে। এখনও পরিবার থেকে চাকুরিটাকেই নিরাপদ মনে করে। কিন্তু এখন সময় এসেছে পরিবর্তনের। আমাদের তরুন প্রজন্ম চাকুরির জন্য নয় নিজে উদ্যোক্তা হবার চেষ্টা করে সফল হচ্ছে। বাংলাদেশে সবচেয়ে কমমূল্যে প্রচুর মানব সম্পদ আছে। পৃথিবীর কোথাও এমনটা নাই। বাংলাদেশী মানব সম্পদ যেমন কর্মঠ তেমনি মেধাসম্পন্ন। এ সুনাম পৃথিবীজুরেই রয়েছে। আমাদের দেশে এখন প্রচুর এগ্রো পণ্য আছে এগুলো আমরা বিভিন্ন দেশে বিক্রি করতে পারি। আফ্রিকাতে একটি বড় বাজার আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। শুধু চায়নাতেই আমরা ১০০ এর বেশী পণ্য রপ্তানী করতে পারি। পাট ও পাট জাতীয় পণ্য, এগ্রো পণ্য, সামুদ্রিক খাবার, গরুর লেজ, গরুর খুর, চামড়া, মেয়েদের চুল ইত্যাদি এখনই খুব ডিমান্ড চায়নাতে।তরুন প্রজন্মকে বলবো চায়না একবার ভিজিট করেন দেখেন অভিজ্ঞতা নিয়ে নিজেকে উদ্যোক্তা হিসাবে গড়ে তুলুন।
শিক্ষাবিচিত্রা: আপনাকে ধন্যবাদ।
মো: আবদুল মোমেন: শিক্ষাবিচিত্রাকেও ধন্যবাদ।