রবিবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী ২০২৩
প্রথম পাতা » Default Category » ‘বিশ্বদরবারে নিজেদের জানান দেবার সময় হয়েছে’ - মোঃ তানভীর হোসেন
‘বিশ্বদরবারে নিজেদের জানান দেবার সময় হয়েছে’ - মোঃ তানভীর হোসেন
জলবায়ু পরিবর্তন, কোভিড-১৯ মহামারী, অর্থনৈতিক মন্দা কিংবা রাশিয়া -ইউক্রেণ যুদ্ধের আঁচ যখন বাংলাদেশের উন্নয়নকে চোখ রাঙাচ্ছে, তখন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের পাশাপাশি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলো দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন নিয়ে নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বা এনজিওগুলো সরকারের সহায়ক শক্তি হিসেবে রাষ্ট্রের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। দুর্যোগ মোকাবেলায় বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের যে সুখ্যাতি রয়েছে, তারই ধারাবাহিকতায় কোভিড-১৯ করোনা মহামারি মোকাবেলায় বাংলাদেশ অনন্য নজির স্থাপন করতে পেরেছে। কিন্তু বর্তমান সময়ে আমাদের একটু ভিন্ন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে । রাশিয়া -ইউক্রেণ যুদ্ধের কারণে ইউরোপ ও আমেরিকার সামাজিক উন্নয়ন তহবিলগুলো কৌশলগত ভাবে দিক পরিবর্তন করেছে বা রক্ষণশীল ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে । সে জন্য বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বা এনজিওগুলোকেও নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। অল্পকয়টি প্রতিষ্ঠিত এনজিও ছাড়া বাকিদের ফান্ড সংকট যেমন রয়েছে, তেমনি দক্ষ জনবলেরও সংকট রয়েছে। অনুদান সংগ্রহের দৌড়ে পিছিয়ে পড়ছে স্থানীয় এনজিওগুলো। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলো তাদের কর্মীদের যে ধরণের সুবিধা দিয়ে থাকে, সে তুলনায় স্থানীয় এনজিওগুলো কর্মী ধরে রাখতেই হিমশিম খাচ্ছে। এসবের মধ্যেও কেউ কেউ আছেন যারা আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার চাকুরী ছেড়ে দেশীয় এনজিও গড়ে তুলতে কাজ করে যাচ্ছেন। মোঃ তানভীর হোসেন, নির্বাহী পরিচালক, এসোসিয়েশন ফর কমিউনিটি এমপাওয়ারমেন্ট (এইস) সেই রকমের একজন মানুষ। আমাদের এবারের আলাপচারিতায় মোঃ তানভীর হোসেন কথা বলেছেন বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের বিভিন্ন দিক নিয়ে, খোলামেলা মন্তব্য করেছেন দেশের এনজিওগুলোর ভৰিষ্যৎ নিয়ে।
শিক্ষা বিচিত্রা: দেশীয় এনজিওতে কেন আসলেন? আন্তর্জাতিক এনজিও এবং দেশীয় এনজিওতে কাজ করার পার্থ্যক্যগুলো কি রকম ?
তানভীর হোসেন: আমার মনে হয় এনজিওতে কাজ করা আর অন্য পেশায় কাজ করার মধ্যে খানিকটা পার্থ্যক্য আছে; অনেকটাই সাংবাদিকতার মত, যারা দেশের জন্য, মানুষের জন্য কিছু করতে চায়, তারাই এইধরণের পেশায় আসেন। আমি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজ করার অভিজ্ঞতার আলোকে দেশীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে চেয়েছি, সেজন্যই এইস এর সাথে যুক্ত হওয়া। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক এনজিও এবং দেশীয় এনজিওতে কাজ করার অনেক পার্থ্যক্য। আন্তর্জাতিক এনজিওগুলো বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই স্ট্র্যাটেজি ডেভেলপমেন্ট, প্রজেক্ট ডিজাইন, পলিসি, প্রসেস, মেথডোলজি, ট্রেইনিং, মনিটরিং এন্ড ইভালুয়েশান নিয়ে কাজ করে; অন্যদিকে দেশীয় এনজিওগুলো প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন এ বেশী মনোযোগী, পলিসি ও প্রসেস ওরিয়েন্টেশনে এখানে কিছু দুর্বলতা থেকে থাকতে পারে।
শিক্ষা বিচিত্রা: গত পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশে হাজার হাজার এনজিও প্রতিষ্ঠা হয়েছে, আপনার কি মনে হয়, আরো নতুন নতুন এনজিও প্রতিষ্ঠান এর দরকার আছে ?
তানভীর হোসেন: তা নিশ্চয়ই আছে। দেখুন হাজার হাজার এনজিও প্রতিষ্ঠা হয়েছে সে কথা সত্য, কিন্তু কয়টি এক্টিভ ভাবে কাজ করছে, কয়টি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে জন্মে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করছে, সে হিসাব করাটা জরুরি। বিশ্বব্যাপী উন্নয়নের ধারণা ও উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তার নানা পরিবর্তন এসেছে, তাই নতুন নতুন প্রতিষ্ঠানও সৃষ্টি হচ্ছে। স্টার্টআপ কোম্পানিগুলোকে সবাই যেমন এপ্রিসিয়েট করছে, তেমনি স্টার্টআপ এনজিওগুলোকেও এপ্রিসিয়েট করা উচিত। কারণ তারা নতুন রিসার্চ ফাইন্ডিংস, ইনোভেটিভ আইডিয়া নিয়ে সমাজকে এগিয়ে নিতে চাচ্ছে, এই ক্ষেত্রে সরকার ও অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের আরও সহযোগিতা বাড়ানো দরকার।
শিক্ষা বিচিত্রা: এসোসিয়েশন ফর কমিউনিটি এমপাওয়ারমেন্ট (এইস) কোন কোন বিষয়ে কাজ করছে, এবং আপনাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি ?
তানভীর হোসেন : আমাদের অগ্রাধিকারপূর্ণ বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে, এনভেয়রনমেন্টাল সাস্টেইনিবিলিটি, কমিউনিটি এমপাওয়ারমেন্ট, হেল্থ এন্ড নিউট্রেশন, ইয়ুথ এনাজেমেন্ট, মার্কে টসিস্টেম স্ট্রাইংথেনিং, রিসার্চ এবং ইমার্জেন্সি রেসপন্স। আমরা এস আর ফাউন্ডেশন এবং কোকাকোলা ফাউন্ডেশন এর সহযোগিতায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় প্লাষ্টিক বোতল অপসারণ ও রিসাইকেলের কাজ করছি। আমরা একটি কমিউনিটি রিসাইকেল সেন্টার স্থাপন করেছি যেখানে ৩০০ জন পরিচ্ছন্নতা কর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্যরা সরাসরি উপকারভোগী হিসেবে যুক্ত আছেন। এছাড়া, ওশান ফাউন্ডেশন, ফ্রান্স এর সহযোগিতায় দুইটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে ন্যায্য মূল্যের দোকান প্রতিষ্ঠা করেছি। এই দোকানগুলো থেকে পোশাককর্মীরা বাজার মূল্য থেকে ১০ পার্সেন্ট কম মূল্যে নিত্যপণ্য কিনতে পারছেন যা সরাসরি তাদের শরীরের পুষ্টি চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখছে। এর সাথে আমরা পোশাক কর্মীদের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও মাসিক ব্যবস্থাপনার উপর প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। আমরা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় গনস্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণা মুলুক কাজ করছি। আমাদের ভবিষ্যতের বড় লক্ষ্যের মধ্যে রয়েছে শিক্ষিত নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ণ নিয়ে কাজ করা ও তরুণদের মানবসম্পদ হিসেবে গড়েতোলার জন্য কাজ করা।
শিক্ষা বিচিত্রা: মানবসম্পদ উন্নয়ন বলতে আপনি কি বোঝাতে চেয়েছেন ? আমাদের তরুণদের সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধ কে আপনি কিভাবে বিবেচনা করেন ?
তানভীর হোসেন: দুটো প্রশ্নকেই আমি একসাথে উত্তর দেয়ার চেষ্টা করি। বাংলাদেশ একটি তারুণ্য নির্ভর দেশ, আমাদের গড় বয়স ত্রিশ বছরের নিচে, সুতারং আমাদের রয়েছে অমিত সম্ভাবনা। কিন্তু সেটা কেবল তখনই সম্ভব, যখন আমাদের তরুণ রা মানব সম্পদে রূপান্তর হবে। অর্থাৎ শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, আধুনিক প্রযুক্তি, স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে তরুণদের অধিকতর দক্ষ ও উৎপাদনশীল করা। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ঘনবসতির স্বল্প আয়তনের এই দেশে প্রধান সম্পদ মানুষ। মানব সম্পদ উন্নয়নে সরাসরি ভূমিকা রাখে স্বাস্থ্য ও প্রায়োগিক শিক্ষা। আমাদের মনে রাখতে হবে, বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির কালে জনগণের আয়, মানসম্পন্ন শিক্ষা ও গণস্বাস্থ্য উন্নয়নের এই তিনটি সূচকই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তা সত্বেও আমাদের তরুণরা নানান উদ্যোগ নিয়ে নিজেদের বিস্তৃত করেছে। এখন এদের সফ্ট স্কিল বাড়াতে হবে, আমাদের প্রমান করতে হবে আমাদের তরুণরা প্রগতিশীলতায় ও কর্মদক্ষতায় বিশ্ব মানের। বিশ্বে আমাদের সেই কথা জানান দেবার সময় এসেছে। শিক্ষিত নারীদের কর্মপরিবেশ ও ব্যবসায়ের সুযোগ সৃষ্টিতে কাজ করতে হবে। বিশ্বব্যাপী তরুণদের নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ নিয়ে নানান তর্ক হচ্ছে, গবেষনাও হচ্ছে। এর মূলেই রয়েছে যোগাযোগ প্রযুক্তির অসাধারণ উন্নয়ন। এখনকার সময়ের সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় নৈতিক মানদন্ড স্থাপনের সুযোগ কম, তথ্য বিচার বিশ্লেষণের সুযোগ কম, তার উপর রয়েছে পাহাড়সম প্রতিযোগিতার ভার। সুতারং গভীর ভাবে চিন্তা করে তরুণরা এগুতে পারছে না। সমাজ যতটা চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে, তরুণরাও সংকটে রয়েছে। আমার মনে হয়ে, সবার আগে পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসা উচিত। এই অতি দ্রুত পরিবর্তনশীল সমাজের ব্যালান্স রক্ষায় তরুণদের কথা শুনতে হবে, সংস্কৃতিক বৈচিত্র রক্ষা করতে হবে এবং আমরা চাই আমাদের তরুণরা সমাজবিরোধী কাজে যেন না জড়িয়ে যায়।
শিক্ষা বিচিত্রা: টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সরকার ও উন্নয়ন অংশীদারদের কোন সেক্টরে অধিক গুরুত্ব দেয়া উচিৎ বলে আপনি মনে করেন?
তানভীর হোসেন: আমি মনে করি, বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এমডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পর এসডিজি অর্জনের দিকে আমরা ভালো ভাবেই এগুচ্ছিলাম। কিন্তু তিনটি বড় ইভেন্ট যেমন, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ, করোনা মহামারি, রাশিয়া -ইউক্রেন যুদ্ধ যেগুলো আমাদের উপর বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলে এসব বাধাও ডিঙিয়ে যাওয়া সম্ভব। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন রাজনৈতিক পরিকল্পনার অংশ। বাংলাদেশের উন্নয়ন অংশীদারদের বা এনজিওদের একসাথে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করলে বেশি সুফল পাওয়া যাবে বলে মনে হয়। এনজিওরা যেহেতু দীর্ঘদিন কৃষি নিয়ে কাজ করেছে, তারা জরুরী খাদ্য সংকট মোকাবেলায় ও উৎপাদন, বাজারজাতকরন ও সংরক্ষণে সরকারকে সাহায্য করতে পারে। জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় ও স্বাস্থ্যখাতের জন্য ইমার্জেন্সি তহবিল সৃষ্টি করা দরকার বলে আমি মনে করি।
শিক্ষা বিচিত্রা: আপনাকে ধন্যবাদ।
তানভীর হোসেন: শিক্ষাবিচিত্রার কর্মী ও এর পাঠকদের ধন্যবাদ।